নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 150 বার পঠিত
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় পাঁচ মাস পর ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উত্থাপনের আকস্মিক উদ্যোগ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। নানা স্লোগানে সরব হতে থাকে সংগঠন দুটির ফেসবুক পেজ; অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও তাঁর ফেসবুকে একই ধরনের পোস্ট দেন। কৌতূহল ও উদ্বেগের মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে (সমকাল অনলাইন, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪)।’
সরকারের আহ্বানের পর ৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র প্রদানস্থল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। তবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকারকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রদানের আহ্বান জানায়। এর সপ্তাহখানেক পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দাবিতে ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি জেলায় জেলায় লিফলেট বিতরণ, সমাবেশ ও জনসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা এবং কয়েকদিনের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র বিষয়ে দৃশ্যমান ও কার্যকর উদ্যোগ সরকার না নিলে কঠোর কর্মসূচি দেবে বলে জানায় তারা।
এদিকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রোববার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এটা সম্ভব নাও হতে পারে। ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা করবে। আলোচনা শেষ হওয়ার পরই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। ১৫ জানুয়ারির মধ্যেই যে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না (সমকাল, ৬ জানুয়ারি ২০২৪)।
এ পরিস্থিতিতে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিত, বাস্তবতা এবং এটি থেকে উদ্ভূত কয়েকটি প্রসঙ্গ আরেকবার আলোচনা করে দেখা যেতে পারে।
টানা দেড় দশক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ছলচাতুরীর নির্বাচন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখে। দুঃশাসন, অপরিমিত লুটপাট ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতাকর্মী বছরের পর বছর নিগ্রহ, নির্যাতন ও মামলা-হামলার শিকার হন। এর মধ্যেও দফায় দফায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যান তারা। সরকারের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনে অর্থনীতি শূন্যগর্ভে পরিণত হয়, মানুষ দিশেহারা হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অধিকাংশ মানুষ জড়ো হতে থাকে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই বিস্ফোরণোম্মুখ বারুদ-বাক্সের মুখ খুলে দেয়। ছাত্র-জনতার অকুতোভয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত আন্দোলনে অন্তত দেড় হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়।
অমিত পরাক্রমশালী শেখ হাসিনাকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের সামনে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের স্বপ্ন উপস্থিত হয়। গণতন্ত্র হত্যাসহ সাধারণ মানুষের মতামত প্রকাশে কর্তৃত্ববাদের পুনরাবৃত্তি মানুষ আর দেখতে চায় না। ব্যাংক লুটপাটসহ আত্মীয়স্বজনের উদরপূর্তির মধ্য দিয়ে রাজনীতির নামে পরিবারতন্ত্রের রাজকীয় উপস্থাপনা দেখবার বাসনা মানুষের নাই। তাই ৫ আগস্টের পর থেকে ‘সংস্কার’ শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতে থাকে; সরকারও প্রায় দেড় ডজন সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে ধারণাও দেন। এর মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাস পর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ কেন?
বাস্তব যে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতার দাবি ইশতেহার আকারে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আর কোটাবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বয়ং শেখ হাসিনা গদ্যিচ্যুত হবেন, এটা জুলাইয়ের মধ্যভাগে ধারণা করা অতি কল্পনাবিলাসীর পক্ষেও দুরূহ ছিল। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শেখ হাসিনা ‘রাজাকার’ সম্বোধন করে বলেন, ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা পাবে, নাকি রাজাকারের নাতি-নাতনি পাবে?’ সেই রাতেই রোকেয়া হল থেকে বেরোয় শত শত ছাত্রীর মিছিল; স্লোগান দেয়– ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার। রাজাকার।/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার/ স্বৈরাচার।’
ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে সরাসরি ‘স্বৈরাচার’ বলবার স্পর্ধা যে ছাত্রীরা দেখালেন, তা-ই ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে; ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ দু’হাত মেলে বুক পেতে দিলেন পুলিশের গুলির সামনে। দেশের মানুষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বৈরাচার প্রতিরোধে। মিছিলে মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়তে থাকল। এর মধ্যে শেখ হাসিনার নাটকীয় আচরণ; মেট্রোরেল, বিটিভি ভবনের জন্য কান্না জাতির কাছে নিষ্ঠুর উপহাসের বিষয় হয়। অন্যদিকে তাঁরই নির্দেশে প্রকাশ্য রাজপথে নিজ দেশের পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে পাশের মানুষটি, এর চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য এ দেশের মানুষ আর কোনোদিন দেখেনি। তাই ৩ আগস্ট এক দফায় উপনীত হয় ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
নদীর স্রোত যেমন সাগরে মেশে; শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আর প্রতিবাদের আগুন তখন মিশেছে ঢাকার রাজপথে। রাজধানীর চারদিক থেকে নেমে আসে মানুষের ঢল, আর উপায় থাকে না শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া। ৫ আগস্ট গণভবনে তাই হাজারো মানুষের ভিড়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শিরে মানুষের নৃত্য, সংসদ ভবনে মুক্তির চিৎকার। এসবই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, দমবন্ধ মানুষের আন্তরিক প্রাণোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় স্বৈরাচার। এটা গণঅভ্যুত্থান। না, এই ঘটনাকে বিপ্লব বলবার কোনো কারণ নেই। বিপ্লবের যে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাপর পথরেখা থাকে, এই আন্দোলনে তা ছিল না। এটা একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে নিশ্চিতভাবে ছাত্র-জনতার চ্যালেঞ্জ; এবং সেই চ্যালেঞ্জে ছাত্র-জনতা বিজয়ী; তবে তা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
অনেকে বলবার চেষ্টা করছেন, আন্দোলনে যেহেতু ইশতেহার ছিল না, তাই সংবিধান পরিবর্তনের কথা তখন বলা হয়নি। এখন কেন বলা হচ্ছে?
স্বৈরাচার উৎখাতের অভিজ্ঞতাই নতুন এই জনদাবি নিয়ে আসে। সংবিধানে স্বৈরাচার জন্মের আঁতুড়ঘর পাওয়া গেলে, তা নিশ্চিহ্ন করতে হবে। এ জন্য গণঅভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ বলবার প্রয়োজন দেখি না। একইভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামো সংহত করবার জন্য সংবিধান ও আইনি কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কার সংগত ও সম্ভব। বেশ ক’টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু সংস্কার দ্রুত সম্ভব হবে, কিছু হয়তো হতে সময় লাগবে। তবে সংস্কার ও নির্বাচন সাংঘর্ষিক নয়। আগামী ‘নির্বাচিত’ সরকার গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতাজাত বলে তাদেরও দায়িত্ব থাকবে এ বিষয়ে। এ ধরনের সর্বপ্লাবী অভ্যুত্থানের পর সংশ্লিষ্ট অনেকের আচরণ যুক্তিসংগত ও গণতান্ত্রিক হয় না।
এক ছাত্রনেতা টকশোতে বলেছেন, তাঁর বড় ভাইয়েরা তাঁকে প্রাডো, অডি ইত্যাদি গাড়ি চড়বার জন্য দিচ্ছেন। ছাত্রনেতা গাড়ির দামও জানালেন, দেড় কোটি, দুই কোটি! বললেন, তিনি সেই দুই কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে প্রান্তিক মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছেন!
প্রশ্ন জাগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষের বৈষম্য নিয়ে কোনো কথা বলেছেন? কোনো সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে, মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করবার জন্য?
স্বেচ্ছাচারী শাসককে বিতাড়নের জন্য জোটবদ্ধ হওয়া ‘বিপ্লব’ নয়। বিপ্লবের শেকড় বহুদূর বিস্তৃত। তাই যতদূর দেশের ছাত্র-জনতা পৌঁছেছে, সেটাকেই গুরুত্ব দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক পরমতসহিষ্ণু দেশ তৈরিতে যার যার জায়গা থেকে সৎভাবে অংশগ্রহণ এখন সবচেয়ে উপযুক্ত কর্তব্য। এ জন্য যথার্থ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন সবচেয়ে আগে।
Posted ৮:১৪ এএম | মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।